আয়েশা আক্তার,নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দাবড়ানি খেয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তাবাহিনী ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের মাধ্যমে বাংলদেশের বিজয় সুচিত হয়।১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারী মাসে শেখ মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেহমানদারি শেষ করে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহন করেন। ক্ষমতা গ্রহনের পর তিনি ঘোষনা দেন,”পাকিস্তানবাহিনী সব ধ্বংস করে গেছে, তাই আগামী তিন বছর আমি তোমাদের কিছু দিবার পারুম না”। জণগন তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মুজিবের দলের দুর্বৃত্তদের চোরি-ডাকাতি ও লুটপাট প্র্ত্যক্ষ করে জণগন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ভূত মুজিবকে তাড়া করছিল। তাই সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা না রেখে, সমান্তরাল ‘রক্ষীবাহিনী’ নাম দিয়ে ১৯৭২ মিলিশিয়াবাহিনী গঠন করে ত্রিশ হাজারের মত টগবগে মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে, ঐ বাহিনীকে ‘ইনডেমনিটির’ মাধ্যমে হত্যাকান্ডের বিচার হতে অব্যাহতি দেয় মুজিব।
পাকিস্তান সেনাবিহনীর ৯০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য্য ও অফিসার আত্মসমর্পনের পর ভারতের মাধ্যমে দেশে ফিরে গেলেও তাদের কাউকে সেনাবাহিনীতে পুনরায় যোগ দিতে দেয়া হয়নি। অথচ পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশী সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর সেনাবাহিনীতে আত্মীয়করন করা হয়। এমনি রক্ষীবাহিনীর দুর্বৃত্ত খুনী সদস্যদেরকেও সেনাবাহিনীতে আত্মীয়করনও ছিল সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাাখার পরিকল্পনারই অংশ।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হল। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনে জণগন প্রত্যক্ষ করল কয়েকটি আসনে মুজিব কর্তৃক হেলিকপ্টারে ভোটের বাক্স ঢাকায় এনে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষনা। মুজিবের আসল চেহারা জণসমক্ষে উন্মুক্ত হল। ১৯৭৪ এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩ লক্ষ লোক মারা যায়। ১৯৭৫ এ এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করল মুজিব। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের বিদ্রোহের মাধ্যমে মুজিব হত্যা করে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম করে।
মুজিব হত্যার পর আশা করেছিলাম, জাসদ রাজনৈতিক দল হিসাবে দেশ ও জণগনের জন্য নতুন কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসবে। কিন্তু কেন ব্যর্থ হল তা আজও জানা গেল না। কয়েক মাসের মধ্যেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহন করলেন সামরিক প্রশাসক হিসাবে। পরবর্তীতে DGFI এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাসমূহকে ব্যবহার করে রজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন। ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন করে জয়ী হয়ে জেনারেল জিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামে বিতর্কিত ভূমিকা রাখা শাহ্ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে সমালোচিত হন। তবে জেনারেল জিয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ভাল কাজ করেন: বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, খাল কাটা কর্মসূচী এবং নিজস্ব সততার মাধ্যমে জণ সমর্থন ধরে রাখতে সমর্থ হন।
জেনারেল জিয়ার আমলে কিছু অপ্রীতিকর ও সংবেদনশীল ও অনভিপ্রেত ঘটনারও সূত্রপাত হয়। বিশেষতঃ সেনাবিহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা – পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত সামরিক অফিসারবৃন্দ ও রক্ষীবাহিনী হতে আত্মীয়কৃত অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দের কারনে কয়েকটি ‘সামরিক ক্যু’ এর ঘটনা ঘটে। এ সমস্ত ক্যুতে অংশ গ্র্রহনের অপরাধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির মত কঠোর দন্ড দেয়া হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী অফিসাররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যা কোন ক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ১৯৮১ সালে চট্রগামে সামরিকবাহিনীর সদস্যদের হাতে জেনারেল জিয়া নিহত হন।
১৯৮৩ সালে পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং সামরিকবাহিনীতে আত্মীয়কৃত জেনারেল এররশাদ জণগনের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলে অপসারিত করে ক্ষমতা দখল করে। জিয়ার দেখান পথে DGFI ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাসমূহকে ব্যবহার করে ‘জাতীয় পার্টি’ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ৬ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম যে কাজগুলি করেছিলেন – তাহলে ধর্মীয় ভন্ডামি এবং দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। ১৯৮৯ সালে গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হবার আগে ‘স্বৈরাচার’ খ্যাতি অর্জন করেন। পরে দুর্নীতির অভিযোগে জেলও খেটেছেন। সেই জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীনদের (বিশেষ করে আওয়ামী লীগের) উচ্ছ্বিষ্ট ভোগ করে কোন রকমে এখনও টিকে আছে। দুর্ভাগ্যজনক হল যে, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের অন্যতম জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আ,স,ম, আবদুর রব গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা সেজে স্বৈরশাসক এরশাদকে সমর্থন দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এ অনুষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের দিন ছাড়া জণগন আর কখনো গণতন্ত্র ভোগ করতে পারেনি। ১৯৯০ এর সংসদ নির্বাচনের আগে একটা সর্বজনীন ধারনা ছিল আওয়ামী লীগ জয়লাভ করবে। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগের দিন রাতে বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অতিব জঘন্য ও অশ্লীল ভাষায় বিএনপি ও জেনারেল জিয়া সম্পর্কে যে বিষোদগার করেছিলেন, তার ফলশ্রুতিতে অলৌকিকভাবে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ট আসনে জয়লাভ করে (আমার বক্তব্যের সত্যতা জানতে হাসিনার ঐ ভাষনটি শুনুন)।
১৯৯০ ও ২০০১ এ আওয়ামী লীগ ও ১৯৯৬ এ বিএনপি নির্বাচনে হারার পর দেশে সন্ত্রাস, গাড়ী ও সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও মানুষ হত্যার মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। কিন্তু দুর্বৃত্তদের কখনও বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ২০০৪ এ বিএনপি এর আইনমমন্ত্রী ড. মওদুদ আহমদ বিএনপি দলীয় প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়য়সীমা ৬৫ হতে ৬৭ বছরে বাড়িয়ে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে তাঁকে দিয়ে নির্বাচনে বিএনপির জয়ী করার প্রত্যাশা বুমেরাং হয়ে দেখা দেয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নিবদ্ধ করে।ফলশ্রুতিতে ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এর ভরাডুবি হয়। এ সব নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো তাদের পরাজয়ের কারন অনুসন্ধানে কোন উদ্যোগ গ্রহন করেনি। পরিবারতান্ত্রীক ও একনায়কতান্ত্রীক দল হিসাবে আওয়ামী লীপ ও বিএনপি হতে এ ধরনের প্রত্যাশা করাও অবশ্য বোকামি।
২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের ২৫ তারিখে ঢাকায় বিডিআর হেডকোয়ার্টারে হিংস্র, পৈশাচিক ও ইতিহাসের নিকষ্ট ও জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ২৪ ঘন্টায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকষ মেধাবি অফিসারকে হত্যা করে সেনাবাহিনীকে দুর্বল ও অক্ষম করার মাধ্যমে হাসিনা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুদূর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়িত করেন। শুধু তাই নয় – স্বরাষ্ট্র প্র্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও শেখ হাসিনাকে দায়মুক্তি প্র্রদান করা হয়। হাসিনা এখানেই থেমে থাকেনি। সংবিধানে ৭(ক) যুক্ত করে,’অবৈধভাবে কেউ ক্ষমতা দখল করলে কঠোর শাস্তির বিধান যোগ করে দুর্বল সেনাবাহিনীকে ভয়ের জগতে ঠেলে দিয়ে হাসিনার অনুগত বাহিনীতে পরিনত করে।২০১১ সালে সংবিধান হতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিধান বাতিল করে হাসিনা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সর্বশেষ বাধা অতিক্রম করেন। পরবর্তীতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এ দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের নামে ভন্ডাামি ও ভোট ডাকাতি করে হাসিনা তাঁর চরম অভিলাষ পূর্ন করেন।
২০২৪ সালের ৫ই আগষ্ট ছাত্রদের একক নেতৃত্বে জণ সমর্থনের জোয়ারে হাসিনার পতনের মাধ্যমে দেশ এক পরিবারতান্ত্রীক মুজিব পরিবারের রাহু মূক্ত হয়।
দেশ হতে পরিবারতান্ত্রীক – একনায়কতানন্ত্রীক শাসন ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত করতে হলে এবার রাজনীতিকে জিয়া পরিবারমুক্ত করতে না পারলে, দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্র্তিষ্ঠিত হবে না।